লেখক | : মহাদেব সাহা |
ক্যাটাগরী | : কবিতা সমগ্র |
প্রকাশনী | : অন্যপ্রকাশ |
ভাষা | : বাংলা |
পৃষ্ঠা | : ১৩৬ পাতা |
মুল্য | : ০.০০৳ |
রেটিং |
:
(০)
|
কোন ডাউনলোড রেকর্ড নেই |
—ঐন্দ্রিলা! এখানে!
—কেমন আছিস?
—এইত্ত। বস। অনেকদিন পর দেখা!
—হুঁ, তোর যে আমাকে মনে পড়লো তাতেই অবাক হচ্ছি।
—কি খাবি?
—এখানে চা কফি আর মোগলাই পুরি ছাড়া কিছু মিলে নাকি? আমি কফি নিবো জাস্ট।
আমি সিদ্দিককে ডাক দিলাম। বাচ্চা একটা ছেলে, প্লেনের মতো হাওয়ায় উড়ে চলাফেরা করে। দারুণ ব্যস্ততার সাথে আমার কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে চলে গেল। ঐন্দ্রিলার দিকে ফিরে বললাম,
—আগে কিন্তু এভাবে বসে কথা বলতে ভয় পেতি। তাও এরকম খোলামেলা রেস্টুরেন্টে। এই কেউ এসে দেখে ফেললো কি-না!
—ম্যালাদিন আগের কথা বিমুক্তি। আমি এখন আর ক্লাস এইটের মেয়ে নই যে সবকিছুতে ভয় পাবো।
—তাও কথা। আচ্ছা, মহাদেব সাহাকে এখনও ভাল্লাগে তোর?
সে এবার থামে একটু। একবার আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে, পরে আবার মুখ গোমড়া করে থ মেরে যায়।
—তুই তো কবিতা পড়তি না।
—এখন পড়ি। মহাদেব সাহাকেও পড়ি।
—ওয়েল, আমি পড়ি না আর কবিতা।
—যাহ! ব্যপার না।
খুব মেঘ করে গেলে কখনো কখনো খুব একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করে হলেও চিঠি দিও
এই লাইন দুটো আমাকে একবার বলিস নি তুই? এরপর এগুলো অনেকবার তাড়া করেছে বুঝলি। আজ মনে পড়ে গেল।
দেখলাম ঐন্দ্রিলার মুখে মেঘ বাড়ছে। লজ্জা পেল, নাকি বিরক্তিতে রেগে যাচ্ছে? ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নিল বোধহয়। এরপর গলা চেপে ক্রোধ অভিমান বা লজ্জা ঢাকতে ঢাকতে বললো, ''এসব বলার জন্যই কি ডাকলি আজ?"
আমি বুঝতে পারলাম মাঝখানে প্রায় বছরখানেক পার করে এসেছি। ওকে এভাবে সরাসরি আঘাত করা আমার একদমই সাজে না আর। দোষ ঢাকতে তাই এবার উঠে পড়ে লাগলাম।
— ভালোবাসা ব্যাকরণ মানে না কখনো,
হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো সংবিধান নেই।
যা করেছিলি তা ঠিকই ছিল। এখন তা ঠেকে শিখেছি অবশ্য।
আমার মুখে আবার মহাদেব সাহার পঙক্তি। ঐন্দ্রিলা তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করলো,"মহাদেব সাহাকে নিয়ে পড়লি কেন? আমাকে শুনাবি বলে কবিতাগুলো মুখস্ত করে এসেছিস বুঝি?"
মাথা নাড়লাম। ওকে জানানো প্রয়োজন এখানে কি হচ্ছে।
—রিভিউ লিখছি! মহাদেব সাহাকে নিয়ে।
—কী? আবার আমাকে টেনে এনেছিস রিভিউ লিখতে?
—এটাই আবার এটাও নয়। আমার নিজের মনের সাথেও একটা যুদ্ধ করা দরকার, এইজন্যও তোকে নিয়ে আসলাম।
—বাই! আমি চলে যাচ্ছি, এসব এক্সপেরিমেন্ট চলছে জানলে আসতামই না।
—আরে তোর কফি চলে এসছে। এটা অন্তত শেষ করে যা। বসে পড়। কাম'ন, সিট ডাউন।
ঐন্দ্রিলা এবার বসে। নাহ! এতোদিন পরের এই পুনর্মিলনী একদমই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। ওকে আমি ডেকে এনেছি, তাই সবকিছু ঠিক করার একটা দায়িত্বও আমার উপর এসে বর্তেছে। সেই দায়িত্বপালনের সবচে' কার্যকরী উপায় ভাবতে ভাবতেই সামনে থাকা চা আর ডাল-পুরি ধীরে ধীরে সাবাড় করে চললাম। ঐন্দ্রিলাও সামনে বসে একমনে কফিতে একটু পর পর বিরতি নিয়ে চুমুক দিচ্ছে।
—এই নে, পুরি খা।
—না।
—নে না! তোকে দেখতে দারুণ লাগছে আজ।
এ কথা বলে একটু গুটিয়ে গেলাম। আগেকার দিনে এসব বলার অধিকার ছিল আমার, এখন আর আছে কি না কে জানে! কিন্তু সে ভালোভাবেই সামলে নিলো।
—প্রেম করার জন্যই ডাকলি তাহলে?
—আরে না! ওটা আর কোনোকালে হবেও না আমার। এমনিতেই বললাম। মেয়েদেরকে আজকাল আমার দেখতে ভালো লাগে। এটা নিয়েও কিন্তু মহাদেব সাহার একটা কবিতা আছে। জানিস?
—আমি তোর মতো ওনার বইয়ের রিভিউ লিখছি না যে মুখস্ত করে বসে থাকবো।
—আচ্ছা, শোন তবে।
অন্তত আমার কাছে নারীর মুখের চেয়ে অনবদ্য শিল্প আর কিছু নেই,
তাই নারীর মুখের দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে রই
….
নিতান্ত হ্যাংলা ভেবে পাছে করে নিরব ভর্ৎসনা,
তাই এই পোড়া চোখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখি পার্শ্ববর্তী শোভা, লেক কিংবা জলাশয়
—হয়েছে, আর না! আরও দুটো পুরি আনা তো। ভালো বানায়, অনেকদিন পর খাচ্ছি।
পুরির অর্ডার গেল। নিরবতা আবার কেমন জেঁকে বসছে।
—এই শোন, আমি স্যরি।
ঐন্দ্রিলা চমকায়, অথবা চমকানোর ভান করে।
—কেন?
—তুই সাহসী ড্যুড। এইজন্যই মুখ ফুটে আমাকে ভালো লাগার কথাটা বলতে পেরেছিলি। কিন্তু, আমি এর প্রতিজবাবে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম, তাই না? মাপ চাইছি সেজন্যে। তখন অনেক ভালোভাবেও তোকে না বলা যেতো। কিন্তু তা না করে আমি উলটো…
—তো আজ এতোদিন পর হঠাৎ মাপ চাইতে হলো কেন?
—কি জানি! মহাদেব সাহার কবিতাই দায়ী বোধহয়।
তোমার চোখে যে এতো জল
আর এতো ব্যাকুলতা—
সব বুঝি তবু বুঝি নাই,
এই সামান্য কথা!
বাল্য বান্ধবীর চোখের জল ভালো লাগে না, বুঝলি!
—মর শালা! কবিতা পড়ে তুমি চলে এসেছো ক্ষমা চাইতে, এটলিস্ট এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না।
—করিস না বিশ্বাস। আরও কারণ অবশ্যই আছে। নিজেও প্রেমে পড়েছি, ব্যর্থ প্রেম! ইতিও চলে এসেছে কিছুদিন আগে। সে সমাপ্তি সুন্দর ছিল, কিন্তু এরপরও খুব লেগেছে ভিতরে। তখনই প্রথম বুঝলাম, তোর সঙ্গে বড্ড অনিয়ম করেছি। অ্যান্ড, অবভিয়াস্লি আই ওয়াজ মিসিং মাই ফ্রেন্ড ঐন্দ্রিলা! এক বছরের উপর তোর সঙ্গে কথা নেই!
—হুঁহ। ভালো। মেয়েটা কে?
—জেনে কি লাভ? শেষ তো।
—বল না! শুনি।
— আমার প্রেমিকা প্রথম দেখেছি তাকে বহুদূরে,
উজ্জয়িনীপুরে,
এখনও যেখানে থাকে সেখানে পৌঁছাতে
এক হাজার একশো কোটি নৌমাইল পথ পাড়ি দিতে হয়;
তবু তার আসল ঠিকানা আমার বুকের ঠিক বাঁ পাশে
যেখানে হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করে
পাঁজরের অস্থিতে লেখা তার টেলিফোন নাম্বারের
সকল সংখ্যাগুলি
—বাহ! তোর প্রেমিকার বর্ণনা দিলি? গ্রেট!
—মহাদেব সাহা গ্রেট! পাঁজরের অস্থিতে লেখা টেলিফোন নাম্বার। হাহ! খুব শক্তিশালী, না?
—নাম বল, নাম বল। চিনে রাখি! দেখি কেমন মেয়ে।
—বাহ, অভিমান নাকি রে? অবশ্য অভিমান থাকা ভালো, এইটুকু থাক।
মমতা মমতা বলো অভিমান তারই তো আকার
তারই সে চোখের আঠালো টিপ, জড়োয়া কাতান,
মমতা মমতা বলো অভিমান তারই একনাম
—নিকোটিনে মেতে ছিলি না কোনোদিন, এখন তো মনে হচ্ছে গাঁজাও টানছিস। তোর প্রেমিকাকে নিয়ে আমি অভিমান করতে যাবো কোন দুঃখে?
—না, করতে যাবি না। এমনিতেই বললাম আরকি। অভিমান থাকা ভালো। বাঁধন থাকে।
—হয়েছে, বাদ দে। আকাশটা মেঘলা।
—হ্যা, সকাল থেকেই। বৃষ্টি আসতে গিয়েও আসছে না। আচ্ছা আরিফের সাথে কেমন যাচ্ছে তোর?
—জানিস তাহলে।
—এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কিছু না জেনে থাকা যায়! মাঝখানে তো অনেক কাপল পিক আপ দিলি তোরা। পেয়ার ডিপিও ছিল।
—হুঁ, ভালোই। তবে দেখা হয় না অনেকদিন। কলেজ বন্ধ, সে-ও আর বাড়ি থেকে আসে নি।
—আমার সাথেও অনেকদিন দেখা নেই। এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না । শামসুজ্জোহার একটা দারুণ আবৃত্তি আছে এটার। শুনে দেখিস।
এবার ঐন্দ্রিলা হাসে একটু। ডান হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,"হ্যা, শুনেছি অনেক। ঐ বৃহস্পতিবার যখন বলে—লোম দাঁড়িয়ে যায় হাতের।"
তোমাকে দেখেছিলাম কবে কোন বৃহস্পতিবার,
আর এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না।
—শহরের প্রতিটা মানুষ বিচ্ছেদ বেদনায় আক্রান্ত, সেখানে তোদের দু'জনকে দেখে ভালো লাগে।
—সবকিছু ঠিকঠাক এগোলেই হলো! তোরটা কি? মানে একদম জিরো চান্স?
—হ্যা।
ঘরে ফেরা তোমার অভ্যাসে নেই,
আর পিছু ডাকা আমার সিলেবাসে নেই;
ফিরে পাওয়া এই শহরের ইতিহাসে নেই
—এটা তো মহাদেব সাহার কবিতা না!
—না, কিন্তু মুখে চলে আসায় বলে দিলাম। রিভিউটা একটু বেশি উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে।
—এ সবকিছুই তোলে দিবি? যাহ, ম্যালা বড় হয়ে যাবে তো তাহলে। কেউ পড়বেই না।
—হোক, এটা রিভিউ হয় নি। আমার ইচ্ছেমতো লিখে যাচ্ছি। গুডরিডসে দিবোই না আর। বা দিতেও পারি, তখন এটা যে নিতান্তই পাগলাটে বকবকানি তা উল্লেখ করে দিতে হবে!
—ওরে বাবা, মেঘ ডাকছে! আমরা উঠি বরং। সিদ্দিক! এই সিদ্দিক না ওর নাম? কতো হলো? এই তুই টাকা দে, তুই এনেছিস আমাকে।
টাকা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম ছাদ রেঁস্তোরা থেকে। সিঁড়ি দিয়ে টপ টপ করে নামছি, এমন সময়ই বৃষ্টি আসলো।
—ঐন্দ্রিলা, আমি বৃষ্টিতে ভিজবো। এই কয়েকদিনের দাবদাহে মাথায় আগুন জ্বলছে। সো, বাই! আবার দেখা হবে।
—অবশ্যই। বাই মামা।
—আর শোন, ক্ষমা করছিস তো?
হেসে বললো, ''হ্যা!"
—থ্যাংক্স ম্যান! বিদায়।
আমি রাস্তায় নামলাম। এ বছর বৃষ্টি খুব কম হচ্ছে, তাই লোকজনের হাতে হাতে ছাতাও ঘুরে না। আমার মতো অনেকের গায়েই পড়ছে বৃষ্টির ফোটা, লাগছে বৃষ্টির ছাট। আমি আবার মনে মনে মহাদেব সাহাকে নিয়ে আসলাম। গুনগুন করে বললাম,
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা
লিখে রেখেছে আকাশে।
সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,
এই ভরা বর্ষা।