লেখক | : সমরেশ মজুমদার |
ক্যাটাগরী | : গল্প |
প্রকাশনী | : অরুণি পাবলিকেশন |
ভাষা | : বাংলা |
পৃষ্ঠা | : ৩৭৯ পাতা |
মুল্য | : ০.০০৳ |
রেটিং |
:
(০)
|
কোন ডাউনলোড রেকর্ড নেই |
বাঙালির অন্দরমহল এক বিচিত্র জগৎ। জগৎ পরিবর্তনশীল। অন্দরমহলও তাই বদলাচ্ছে, কিন্তু এর মধ্যে যে একটা জাড়তা আছে তার বুঝি তেমন বদল হয়নি। খুব পুরনাে অন্দরমহলের ছবি একটা না পেলেও গত দেড়শা বছর বা দুশাে বছরের অন্দরমহলের ছবিটা ধরা পড়ে আছে মেয়েদের লেখা নানান আত্মকথায় এমনকি সংবাদ-সাময়িক পত্রের নানান টুকরাে সংবাদে। ইংরেজের সঙ্গে বাঙালির অন্দরমহলের এতােই তফাৎ যে বিলেতের যুবরাজ এসে বাঙালির অন্দরমহল দেখবার জন্যে একদা আঁকুপাঁকু করে উঠেছিলেন। উকিল জগদানন্দ মুখােপাধ্যায় তাকে সে সুযােগ করে দিয়ে একটা ইতিহাস রচনা করেছিলেন।
কি ছিল সে অন্দরমহলে? যা ছিল তা কিন্তু শুধু অন্দরবাসিনীরাই পরিচালনা করতেন না - পুরুষসমাজের তর্জনীসংকেতে তা পরিচালিত হত। ফলে মেয়েরা কারাবাসেই থাকতেন বলা যেতে পারে। এতােটা কড়াকড়ির কারণ বহিরাগত মুসলমানদের উপস্থিতি কিনা বলতে পারি না। তবে ঘােমটার আড়ালে এতখানি থাকার মধ্যে হয়তাে এই বহিরাক্রমণের প্রভাব থাকতেও পারে।
আসলে বালবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ নানান সামাজিক প্রথা ও আচরণ; মেয়েদের বাইরে যেতে মানা, অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে কথা বলায় মানা। এই সব মানার পাহাড়ে তাদের জীবন অনেকটা খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়াতেই অতিবাহিত হয়ে যেত।
এরই মধ্যে ইংরেজরা আসার পর মেয়েদের জীবনেও একটা পরিবর্তন আনার সুযােগ এসে গেছিল। লেখা-পড়া শেখানাের আয়ােজন হতে শুরু হয়েছিল। সেটা মােটামুটি কলকাতাতেই। গ্রামে তখনও এই ঢেউ এসে পড়েনি। নবমীতে লাউ শাক আর দ্বাদশীতে পুই শাক খাওয়ার বাছবিচারেই মেয়েদের জীবন কাটছিল। (এখনও কি এর খুব পরিবর্তন হয়েছে? এখনও বাংলা ভাষার বেস্টসেলার বইটির নাম পঞ্জিকা !!) মেয়েদের লেখাপড়া? সেকালে বলা হত মেয়েরা পড়াশুনাে করলে - বিধবা হবে, সন্তান মরে যাবে এমনকি স্তনের দুধ পর্যন্ত শুকিয়ে যাবে।
এমন সব নিষেধ-মানার মধ্যেও রাসসুন্দরীরা লেখাপড়া শিখেছিলেন লুকিয়ে-চুরিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে জানলা-দরজার ফাঁক কাপড় দিয়ে আড়াল করে রাতের গভীরে আলাে জ্বালিয়ে সংসারের সব কাজ সেরে। স্বামীরাও অবশ্য তাই চেয়েছিলেন। কোন রাসসুন্দরীরা? যারা শশুরের ঘােড়াটিকেও দেখে সসম্মানে ঘােমটা টেনে নিতেন সম্রমে এবং লজ্জাশীলতায়। যাদের মনের ইচ্ছে মনেই মিলিয়ে যেত – স্বাতন্ত্রের কথা যারা মনেও আনতে পারতো না। কারণ তাদের আচরণে পান থেকে চুন খসে পড়লেই ধুন্ধুমার কান্ড বেধে যেত। সমাজ যাই যাই করে উঠত। অথচ বােবা কান্নায় অন্দরমহলের বাতাস ভারী হয়ে উঠত। যুবতী বিধবারা আপনার বয়স্ক পুত্রের সঙ্গেও কথা বলতে পারতেন না নির্জনে – অপর অত্যাচারের আর কি উদাহারণ দেবাে এই ধােয়া তুলসিপাতার পুরুষ সমাজে? গােটা অন্দরমহল জুড়ে সন্দেহ আর অপমানের অন্ধকার, বিধিনিষেধের সীমাহীন বর্বরতা।
সেই কোন এক বালিকা বয়সে - যখন সে কাপড় পড়তে পারত - স্বামীর অন্দরে এসে ঢুকত। আর যদি কুনিন ঘরের বউ হত -- তাহলে তাে কথাই ছিল না। খেলার বয়সেই তারা নিজেরাই খেলনা হয়ে যেত। মেয়েছেলে, বিটিছেলে - সে তাে জুতাের শুকতলা। তাদের নিয়ে ছড়া কাটা হত -
মেয়ের নাম ফেলি
পরে নিলেও গেলি
যমে নিলেও গেলি।
অথবা
মেয়েছেলে মাটির ডেলা
ট্প করে নে জলে ফেলা।
শাশুড়ি ননদের অত্যাচার শােনা যেত বধুর পিঠের খুন্তি পােড়ানাে ছ্যাঁকা চিহ্নে। ছড়ায় শুনতাম -
বড় সরাখানা ভেঙে গেছে
ছােট সরাখানা আছে -
নাচন কোঁদন কর কি বউমা
হাতের আটকান আছে।
- বউরা পেট ভরে খাবে? সংসার রসাতলে যাবে না।
কিন্তু একদিন এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবার বাসনা জাগল। মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করলেন -- ঈশ্বর গুপ্ত ছড়া কাটলেন --
আগে মেয়ে গুলাে ছিল ভাল ব্রতধর্ম করতে সবে
একা বেথুন এসে শেষ করেছে, আর কি
তাদের তেমন পাবে
এবং ‘তারা বিবি সেজে এ-বি পড়ে বিলিতে বােল কবেই কবে’। আটকে রাখতে পারেনি পুরুষ সমাজ মেয়েদের অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যে। অচলায়তন একটু একটু করে ভেঙেছে বই কি!
কিন্তু সত্যিই কি ভেঙেছে। বাঙালি মেয়েরা কি প্রত্যাশিত স্বাধীনতা পেয়েছেন? আপনা মাসে হরিণা বৈরী। মেয়েরা এখনও লােলুপতার শিকার। তবুও বদল যে হয়নি এমন কথা বলি কি করে?
সাহিত্যকে বলা হয়ে থাকে সমাজের প্রতিচ্ছবি। বাংলার ছােটগল্পে এই পরিবর্তনশীল বাঙালির অন্দরমহলের ছবি অবশ্যই ধরা পড়ে আছে। ফলে বাংলার সমাজের একটা বড় অংশের সামাজিকতার ইতিহাস এই গল্পগুলিতে ধরা পড়ে আছে। মেয়েরা আজ ঘরের বাইরে এসেছেন। পুরুষ সমাজ বলছে, তারা সমানাধিকার প্রাপ্ত। একদা কেশব সেন গান গেয়েছিলেন – নরনারী সকলের সমান অধিকার। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছিলেন - না জাগিলে আজি ভারত-ললনা ভারত যে আজ জাগো না জাগে না। কিন্তু এখানেই তাে আবার মেয়েদের জন্যে তেত্রিশ শতাংশের সংরক্ষণের আপাতবিরােধী আন্দোলন করেন মেয়েরাই (নাকি এ-ও পুরুষের কারসাজি) !!
এই যে মেয়েদের ভাগ্য, এই যে মেয়েদের বেরিয়ে আনা (তসলিমাদের মত অবশ্যই নয়) — এই চলচ্ছবিটা ধরে রাখার জন্যেই এই গল্পের সংকলন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার তার ঔদার্যে আমাকে এই সংকলনটি করে দিতে বলেন। এই পরিকল্পনাটি তার মস্তিস্কের ফসল। তবে এই ফসলটিকে মড়াইজাত করার দায় দিয়েছিলেন আমাকে। যে-দায় আমি পালন করার চেষ্টা করেছি। এই আয়ােজনের সঙ্গে সংযুক্ত সকলের কাছেই আমার ঋণ।
গল্পগুলিতে যৌথ পরিবার, ভেঙ্গে যাওয়া যৌথ পরিবার থেকে আপনি আর কপনির ছােট পরিবার সুখী পরিবারের পরিবর্তনশীল ছবি পাঠক পেতে পারেন। এরই মধ্যে অনঙ্গদেবের আশ্চর্য গমনাগমন জীবনের মধ্যে অন্যবিধ মাত্রা এনে দিয়েছে। জীবনে জটিলতাও এসে গেছে আধুনিকতার সঙ্গে সন্দেহ নেই। ছােট বয়সের মাটির তালকে বড়াে করে সংসারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সঙ্গে বড় হয়ে আসা বুলি শেখা পাখিকে নতুন বুলিতে অভ্যস্থ করতে গিয়ে মতবিরােধ বাড়ছে বই কমছে না। বিচ্ছেদ-বিরােধ বাধছে। এরই মধ্যে বাঙালি অন্দরমহল বাঁচার চেষ্টা করছে। এ লড়াই বাঁচার লড়াই কিনা তা যেন সাহস করে বলতে পারছিনা।
গল্পগুলিতে মেয়েদের লেখাপড়া-শেখা, শাশুড়ি স্বামীদের সহযােগিতা বিরােধিতা, বৈধব্য এলে তার অবস্থান অথচ জীবনগঠনের প্রবল আর্তি, স্বামীর অমিতাচার পবিত্রতা স্ত্রীর অন্দরমহলকে যেভাবে বিপর্যস্ত করে এবং যার কারণ হয় অকালমৃত্যু; যৌথ পরিবার কেমন করে ভ্রাতৃবিরােধে ভেঙ্গে যায় এবং জা-দের এতে ভূমিকা - মেয়েরাই মেয়েদের কতখানি শত্রু হয়ে ওঠেন; অন্দরমহলেই লক্ষ্য করা গেছে দেবর ও শ্যালিকাদের অন্যতর প্রেমের, গােপন প্রেমের চিরকালীনতা; স্বামী-শাশুড়ি-বধূ নিয়ে মনােরম সংসার -- চলে যাওয়া মেয়ের বেদনা -- আদুরে আদুরে ছোটদের নিয়ে স্নেহোষ্ণ অন্দরমহল – সংসারের নানা খুঁটিনাটি এমনকি দেশপ্রেমের উৎসার; কালাে মেয়ের পরিণাম ও পাওনা-গন্ডার বিরােধে বিপর্যস্ত অন্দরমহল; বাঙালির অন্দরমহলে বৃদ্ধ মাতা পিতার অবাঞ্ছিত উপস্থিতি; অন্দরমহলের আলােড়নে বর্হিমহলের টালমাটাল ভাব; পারত্রিক আর ঐহিক সংস্কারের টানাপােড়েনে এলােমেলাে অন্দরমহল; অসম-বয়সের বিবাহে যে মৃত্যু তাও যেন এখানে বড়াে কথা নয়; অন্দরমহল কখনও বা বিস্তৃত হয়ে অন্যের অন্দরমহলকে পরিব্যাপ্ত করে; কখনও বা এই মহলে রচিত হয় সাহিত্যের পরিবেশ – জীবন হয় মনােরম; আবার সামান্য সরষের তেল বাজারে অমিল হলেও এই অন্দরমহলে আলােড়ন ওঠে; আবার এগিয়ে আসা আধুনিক অন্দরমহলও বাঙালি লেখকের গল্পে অনিবার্যভাবে ঠাই করে নেয়।
এই যে ওঠা পড়া – এরই একটি ক্রম পরিবর্তনশীল ছবি এই গল্পগুলিতে ধরা পড়ে গেছে। সামাজিক ইতিহাসের এই সাহিত্যিক দলিলটি একালের পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারার একটা দায়বদ্ধতা আমরা স্বীকার করেই নিয়েছি।
যাদের গল্প নিয়েছি, তাদের সকলের প্রতি আমাদের বিনম্র কৃতজ্ঞতা।
সূচিপত্র
১। বিপত্নীকের পত্নী - নৃত্যকালী দেবী
২। অনাদৃত - অমিয়া চৌধুরী
৩। কল্যানী - উর্মিলা দেবী
৪। পূজার তত্ত্ব - সীতা দেবী
৫। পরিনীতা - নিখিলবালা সেনগুপ্ত
৬। রিক্তা - পূর্ণশশী দেবী
৭। সহযােগ - সরযুবালা বসু
৮। চাকুরে ভাই - দীনেন্দ্র কুমার রায়
৯। দেবদূত - রাসবিহারী মন্ডল
১০। মায়ের দিন - মনীন্দ্রলাল বসু
১১। কই মাছ - আশাপূর্ণা দেবী
১২। মাথাধরা - আশাপূর্ণা দেবী
১৩। দর ও দস্তুর - জ্যোতির্ময়ী দেবী
১৪। সংসার - তারাশঙ্কর বন্ধোপ্যাধ্যায়
১৫। বেহিসাবী - সরােজকুমার রায়চৌধুরী
১৬। সাতাশে শ্রাবণ - বিমল মিত্র
১৭। ফুলশয্যার ইতিহাস - গজেন্দ্র কুমার মিত্র
১৮। চিরন্তন ভ্রান্তি - আশালতা সিংহ
১৯। বিবাহবার্ষিকী - নরেন্দ্রনাথ মিত্র
২০। অসমাপ্ত স্বামী স্ত্রী সংলাপ - বানী রায়
২১। মঞ্জরীর বেহায়াপনা - আশা দেবী
২২। স্রেফ তেল দিয়ে - অখিল নিয়ােগী
২৩। বৌরাণী - রমাপদ চৌধুরী
২৪। খেলতে খেলতে, একদিন - কবিতা সিংহ
২৫। দিদিমা - শরৎকুমারী চৌধুরানী
২৬। মেয়ে যজ্ঞি - শরৎকুমারী চৌধুরাণী
২৭। সেকালের শ্বশুরবাড়ী - জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।